মোহনবাগান টিমের ফুটবলাররা সবাই মিলে অনুরোধ করলেন মান্নাদাকে মোহনবাগানের ফুটবল-কোচ হওয়ার জন্য। পড়তে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন তো? ঘটনাটা শুনুন।
মান্নাদার ক্রীড়া-প্রোমের কথা সবাই জানেন। সব ধরনের খেলা ভালবাসতেন। তবে ফুটবলের প্রতি ভালবাসাটা একটু বেশি ছিল। এই নিয়ে তো কত গল্প আছে। শচীন দেব বর্মন কট্টর ইস্টবেঙ্গল সমর্থক, মান্নাদা মোহনবাগানের সমর্থক। মুম্বাইয়ে খেলা থাকলে দেখবেনই দু’জনে। বসবেনও খেলা দেখতে এক সঙ্গে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলা চলছে, মোহনবাগান গোল করে দিল। মান্নাদা আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। সে দিকে তাকিয়ে শচীনকর্তা রাগে গরগর করতে করতে বললেন—‘তুই মোহনবাগান, মোহনবাগান কইরা মর। তর আর গান গাইতে হইব না।’
মান্নাদা একবার ট্রেনে যাচ্ছেন অনুষ্ঠান করতে। সঙ্গে প্রিয় বাদ্যযন্ত্রীরা—তার মধ্যে আছে মান্নাদার প্রিয় তবলিয়া দীপঙ্কর আচার্য। ভালই গল্প-গুজব চলছে। আর মনের মতো মানুষ পেয়ে মান্নাদা যে কী রকম আড্ডায় জমে ওঠেন, যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন। সেই একই কামরায় উঠেছে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলোয়াড়রা, খেলতে যাচ্ছে। মান্নাদাকে দেখে সবাই ছুটে এল। এতো হাতে চাঁদ পাওয়া। আড্ডা বেশ ভালই জমে উঠেছে। মান্নাদা এ বার পড়লেন মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের নিয়ে। সবাই তাঁর প্রিয়, অত্যন্ত স্নেহের। অনেকের সঙ্গে মান্নাদার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভাল। ফুটবল খেলাটা অন্তর থেকে ভালবাসেন। টেলিভিসনে পৃথিবীর ভাল ভাল সব খেলা দেখেন—অধিকাংশ রাত জেগে। খেলাটা দারুণ বোঝেন। কয়েক দিন আগে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানকে হারিয়ে দিয়েছে, মান্নাদা দারুণ দুঃখে ছিলেন। এ বার মোহনবাগান প্লেয়ারদের কাছে পেয়ে মান্নাদা খুব বকা-ঝকা করতে আরম্ভ করলেন। সে দিন কার কি ভুল হয়েছে তাও বলতে থাকলেন—তুমি কেন অত সময় বল হোল্ড করেছিলে, এত সিটার মিস করলে জেতা যায়, ডেড বল সিচুয়েশনগুলো একটাও কাজে লাগাতে পারলে না....? সবাই বাধ্য ছেলের মতো শুনছে। মান্নাদার কথা শেষ হলে মোহনবাগানের সব খেলোয়াড় সমস্বরে বলল—‘মান্নাদা, আপনিই মোগনবাগানের কোচ হয়ে যান এ বার।’ সে কথা শুনে মান্নাদার সে কি হাসি।
মান্নাদার অসাধারণ রসবোধের একটা ঘটনা বলি। সলিল দত্তের ‘ঘরের বাইরে ঘর’ ছবির কাজ চলছে। গান লিখেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরকার মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়। মান্নাদা গাইবেন ‘আয় বৃষ্টি রে’। মৃণালদা দীপঙ্কর আচার্যকে নিয়ে মদন ঘোষ লেনে এসেছেন মান্নাদাকে গানটা শোনাতে। সঙ্গে তবলা থাকলে গানটা গাইতে এবং শোনাতে সুবিধা হয়। গানের এমন সিটিংয়ে এবং আড্ডায় চা এবং স্ন্যাক্স সহযোগে মান্নাদার অসাধারণ আপ্যায়ন—কোনও দিনই অন্যথা হয়নি। গান চলছে, পকোড়া এল এক প্লেট। সবাই খাচ্ছে। দু’হাত দিয়ে তবলা বাজাচ্ছে, প্লটটাও দূরে। দীপঙ্কর আর খাওয়ার সুযোগ পেল না। প্লেট শেষ। আবার প্লেট ভর্তি গরম গরম পকোড়া এল। এ বার দীপঙ্কর প্লেটটা তার পাশে এনে রাখল। এক হাতে তাল রেখে, অন্য হাত দিয়ে মাঝে মাঝে প্লেট থেকে পকোড়া তুলে মুখে দিচ্ছে। রসিক মান্নাদা সেটালক্ষ্য করেছেন। এ বার যখনই দীপঙ্কর এক হাতে তাল রেখে, অন্য হাতে পকোড়া তুলছে, মান্নাদা ততবারই বলে উঠছেন— ‘কেয়া বাত কেয়া বাত’।
মান্নাদা অনেক বার বলেছেন, তাঁর বাংলাগানের প্রকৃত শ্রোতা বাংলাদেশের মানুষ। সত্যিই তাই। মান্নাদা দুঃখ করে বলতেন, ‘এখানে তো সবাই ঘুরে-ফিরে ওই কুড়ি পঁচিশটা বাংলাগানই শুনতে চায়। মনে হয় ‘আমায় একটু জায়গা দাও’ গানটা ছাড়া গত পঁচিশ বছরে আমি আর কোনও গান রেকর্ড করিনি। কিন্তু বাংলাদেশে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে দেখেছি, ওরা আমার সব গানের খবর রাখে। ওরা অন্য গানের সঙ্গে শুনতে চায় ‘দুঃখ আমাকে দুঃখী করে নি’, ‘যে সমাধি বেদিটার’, ‘মিষ্টি একটা গন্ধ’, ‘চিঠি লিখে ভুলে গেলে জুড়ে দিতে খাম’, ‘সহেলি গো’— এই সব কত গান। সব অনুষ্ঠানে ওরা অনুরোধ করবেই ‘তুই কি আমার পুতুল পুতুল সেই ছোট্ট মেয়ে’ গাইবার জন্য। বাবা-মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে কি অসাধারণ গান লিখেছিলেন মিন্টুবাবু (ঘোষ)। ওর লেখা ‘বড় একা লাগে’ আমার খুব প্রিয় গান। এখানে তো এ সব গান কেউ শুনতে চায় না। আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন, বাংলাদেশের মানুষরা অনেক সময় এমন গানের জন্য অনুরোধ করেন, না-গাইতে গাইতে আমি হয়তো কথা সব ভুলে গিয়েছি। ওরাও ছাড়বার পাত্র নয়। বলছে, আপনি গাইতে থাকুন, ‘কথা’ আমরা মনে করিয়ে দেব। কী আশ্চর্য সব গানের কথা ওদের মুখস্থ।’ এই বাংলার মনীষীদের নিয়ে মান্নাদা অসাধারণ গানের অ্যালবাম ‘আমার প্রিয় মনীষী’—সে রকম ভাবে অনেকে এখানে শোনেননি। অথচ বাংলাদেশে গানগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এমনকী সেই অ্যালবামের ‘পাইরেসি’ পর্যন্ত রয়েছে। ‘পাইরেসি’—অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু জনপ্রিয়তার যে মাপকাঠি, তা অস্বীকার করবেন কি করে? আবার সেই বাংলাদেশে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে মান্নাদা বাধাপ্রাপ্তও হয়েছেন। হলের বাইরে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ রাস্তায় শুয়ে পড়েছেন। ধন নয়, মান নয়,— তাদের একটাই অনুরোধ, শুয়ে পড়া মানুষদের উপর দিয়ে হেঁটে মান্নাদা যেন হলে প্রবেশ করেন। সঙ্গীতের ঈশ্বর এসেছেন। তাঁর পায়ের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হওয়া যায়? বলতে বলতে মান্নাদার চোখে জলএসে যেত, যে শুনতো তারও। ২০১০ সালের ১ মে মহাজাতি সদনে ভারতবর্ষে মান্নাদা শেষ অনুষ্ঠানে প্রায় এ রকমই ঘটনা ঘটেছিল। অনুষ্ঠান শেষ। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে, একবার মান্নাদাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য। অবশেষে বিরাট পুলিশ বাহিনী এসে সবাইকে করজোড়ে অনুরোধ করে মান্নাদাকে যাওয়ার পথ করে দেয়। দু’চোখে চিক চিক করা জল নিয়ে মান্নাদা ফিরে যান মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে।
এক ক্লান্ত, বিধ্বস্ত কৃষকের মুখ। আমি দেখিনি। ঘটনাটা দীপঙ্করের কাছে শোনা। সদলবলে গাড়ি করে মান্নাদা বাঁকুড়ায় যাচ্ছেন অনুষ্ঠান করতে। পথে একটা গ্রাম পড়ল। মান্নাদা দেখলেন বিরাট একটা মোট মাথায় নিয়ে একজন বয়স্ক কৃষক চলেছেন—হয়তো কোনও দূরের হাটে বেচতে। ভারী মোটের ওজনে শরীর নুয়ে পড়েছে। আরও কত দূর যেতে হবে কে জানে! মান্নাদা গাড়ি থামালেন। সেই কৃষকের কাছ থেকে ওই মোটের মধ্যে যত সব্জি ছিল সব কিনে নিলেন—প্রচুর লাউ, কুমড়ো, কপি আর সব কিছু। সবাই বলল, মান্নাদা এত সব্জি নিয়ে কী করবেন? মান্নাদা বললেন, ‘তোমরা ভাগ করে নাও। মানুষটার এত বয়স হয়েছে। এই বয়সে এই ভার বওয়া ওর পক্ষে সম্ভব ? আমি বোঝাটাকে একটু হাল্কা করে দিলাম শুধু’।
এমন কোমল হৃদয় মান্নাদার। তিনি মস্তিস্ক দিয়ে সঙ্গীত-বিদ্যা আহরণ করেছেন। আর হৃদয়ের অমৃর-রসে সেই বিদ্যা চুবিয়ে তিনি উপহার দিয়েছেন এক একটা অমূল্য রত্ন। আমরা তাকে মান্না দের গান বলেই জানি।
No comments:
Post a Comment