নিজেদের পছন্দের ঘূর্ণি উইকেটে টস হেরে নাইটরা নিজেরাই চোরাবালিতে তলিয়ে যাবে কি না বিস্তর গবেষণা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল শনিবারের রাত না অতর্কিত কালো রাত হয়ে দাঁড়ায় তাদের জন্য।
মধ্যরাত অতিক্রান্ত ইডেনে ন’ওভারে ৬৬ করতে হবে এই তাড়ায় প্রথম ওভারেই কি না দু’উইকেট। দুর্মর কেকেআর সমর্থকেরা অত রাতে কী ভাবে বাড়ি ফিরবেন জানেন না। কিন্তু আশ্চর্য স্পিরিট তখনও কেউ ইডেন ছাড়েননি।

আর সেই অনুগত জনস্রোতকে অসামান্য মর্যাদা দিলেন ইউসুফ পাঠান। নাইট ইনিংসের তৃতীয় ওভারে খেলাটার মীমাংসা হয়ে গেল। যখন বিপক্ষের এক নম্বর অস্ত্র অশ্বিনকে উড়িয়ে দিয়ে এক ওভারে ২২ নিলেন ইউসুফ। পরের ওভারে অন্য অশ্বিন মুরুগনের একই দশা। আগের ম্যাচে ছ’উইকেট নেওয়া অ্যাডাম জাম্পা? তিনি জাম্পার খোলার আগেই ম্যাচ শেষ। করতে পারলেন মাত্র শেষ ওভার।
গভীর রাতের ম্যাচ জিতে এ দিন মাঠে না থাকা এসআরকে-র কেকেআর সেমিফাইনালের দোরগোড়ায়। লিগ টেবলে দু’নম্বরে। জিততে হবে বাকি তিনটের একটা ম্যাচ। অবশ্যই হয়ে যাওয়া উচিত। তাদের বারবার একটা দল দেখাচ্ছে। যারা নিজেদের ব্যাটিং স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত গম্ভীর-উথাপ্পা ওপেনিং কম্বিনেশন ব্যর্থ হলেও চাপের ম্যাচ বার করে দিতে পারে।
ইউসুফের প্রচুর ধারদেনা ছিল নাইট কর্তৃপক্ষের কাছে। বহু বছর সে ভাবে ম্যাচ জেতাচ্ছিলেন না। ভারত দূরে থাক, অন্য ফ্র্যাঞ্চাজিরাও তাঁর সম্পর্কে উৎসাহ দেখাচ্ছিল না। অথচ এ মরসুমে ম্যাচ উইনিং ইনিংস হল তিন। গঙ্গার ধারে এ দিন করলেন ১৮ বলে অপরাজিত ৩৭। ইউসুফের প্রকাণ্ড সব ছক্কাগুলো মনে করাচ্ছিল হারিয়ে যাওয়া এক টি-টোয়েন্টি ওস্তাদকে। ইনিও প্রচণ্ড মারতেন। এক কালে ছক্কা মারিয়ে হিসেবে বাড়তি প্রসিদ্ধ ছিলেন। এ দিন অবশ্য ২২ বল খেলে করেছেন ৮। স্ট্রাইকরেট ৩৬-এর আশেপাশে। তিনি মহেন্দ্র সিংহ ধোনি? না, তাঁর বায়োপিকে অভিনয় করা সুশান্ত সিংহ রাজপুত? তদন্ত হলে খারাপ হয় না!
কেকেআর একপেশে জিতলেও ম্যাচ ঘিরে কত রকম মুহূর্ত তৈরি হচ্ছিল ইডেনে। টানা বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ থাকার সময় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আবার ঘণ্টাদেড়েক মাঠে দাঁড়িয়ে জল-নিকাশি ব্যবস্থার তদারকি করলেন। একটা সময় সৌরভের ক্রিকেটজীবনের অন্তিম শোকগাথা অভিনীত হচ্ছিল ধোনির সামনে। আজ যে ধোনিকে চোখের সামনে সৌরভ দেখলেন, তিনি কি ‘দি এন্ডের’ খুব কাছাকাছি এসে যাননি? সময় বলবে।
তবে তাঁকে যদি সঞ্জীব গোয়েন্কা পরের মরসুমেও পুণে অধিনায়ক রাখেন এটিকেতে হাবাস ফিরে আসার মতোই অত্যাশ্চর্য ব্যাপার ঘটবে।
শুধু তো হার নয়। শুধু তো নিজের জীবনের সবচেয়ে অসম্মানজনক টি-টোয়েন্টি হিসেব নয় যে, বারো ম্যাচের ন’টায় হারলাম। যে যেখানে পারছে হারের সঙ্গে তাঁকে গুঁজে দিচ্ছে এত দিনের জমে থাকা সব প্যাকেজ। হায়দরাবাদে তাঁকে রান আউট করে যুবরাজ সিংহ যে উল্লাস দেখিয়েছিলেন তা উসেইন বোল্ট দেখিয়ে থাকেন অলিম্পিক্সে সোনা জেতার পর। যুবরাজের ওই উল্লাসে অবশ্যই কিছু শোধবোধও জমে ছিল। শনিবারের ইডেন যাকে ছাপিয়ে বাচ্চাদের রাগ করে দিল।
প্রেসবক্সে বসে ভাবার চেষ্টা করছিলাম, নাইটদের ইনিংসের প্রথম ওভারে স্টাম্পের পিছনে দাঁড়িয়ে কী ভাবছেন ধোনি?
ডাকওয়ার্থ লুইসে নতুন করে শুরু হওয়া ম্যাচে প্রথম ওভারে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সামনে গৌতম গম্ভীর।
ব্যাটসম্যান তাঁর ঘোষিত ধারাবাহিক শত্রু।
   বোলার তাঁর হালফিলের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ।
গম্ভীরকে প্রথম বলেই আউট করে দিলেন অশ্বিন। তার আগে উথাপ্পাকে অশ্বিনের বলেই স্টাম্প করেছেন ধোনি। মনে হচ্ছে মরসুমে প্রথম আজ ধোনি-অশ্বিন হাই-হ্যালো হতে পারে। এই সময় ব্যাটিং-চাবুক নিয়ে পুণে বোলিংকে জাস্ট ছেলেখেলা করে দিলেন ইউসুফ। টার্নারে ধোনি যেখানে বিদেশিদের আগে ব্যাট করতে পাঠাচ্ছিলেন। সেখানে গম্ভীর ধূর্ত চালে আগে পাঠালেন ভারতীয়দের। ব্যাট হাতে এক বলে আউট। কিন্তু ম্যাচ জেতাই শুধু নয়, অধিনায়কত্বে পিছনে ফেলে দিলেন সেই এমএসডিকে। এক সময় যাঁর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। তখন অবশ্য ডলারের দাম কত ছিল নেট খুলে দেখতে হবে!
কতটা পথ হেঁটে গেলে পথিক হওয়া যায়?
কতটা প্রতিহিংসা জমে থাকলে এ ভাবে ফিল্ড সাজানো যায়?
শনিবার পুণে অধিনায়ক ব্যাট করতে আসা মাত্র কেকেআর অধিনায়ক আবার তাঁর জন্য সেই ফিল্ড সাজিয়ে দিলেন। কোনটা? হপ্তাখানেক আগে যা পুণের মাঠে তাঁর জন্যই সাজিয়েছিলেন। সিলি পয়েন্ট। ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ। সিলি মিড অফ। স্লিপ।
পুণের মাঠে এতটা চোখে লাগেনি। আনন্দবাজারে ম্যাচ রিপোর্টে লেখা হলেও কেউ কেউ হালকা বেনিফিট অব ডাউট দিয়েছিলেন গম্ভীরকে। হয়তো পরিস্থিতি অনুযায়ী ওটার দরকার পড়েছিল। শনিবার সন্দেহের পর্দাটা হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়েই দিলেন কেকেআর অধিনায়ক। বাকি পৃথিবী দেখুক, বুঝুক, যা ইচ্ছে বলুক, তাঁর কিছু এসে যায় না। বাকি পৃথিবী তো তাঁর রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকার সময় পাশে ছিল না। এখন তারা শালীনতার মাত্রা নিয়ে যা ইচ্ছে মন্তব্য করুক, তাঁর কিছু আসে যায় না।
গোটা পুণে ইনিংসে আর কারও জন্য এই ফিল্ড নেই। এমনকী খোয়াজা বা বেইলির মতো বিদেশিদের জন্যও না। চাঁদমারি ওই একটাই লোক! ধোনি রান নিয়ে ওই প্রান্তে চলে গেলে নন স্ট্রাইকার ইরফান পাঠানের জন্য নেই। এর পর নামা অশ্বিনের জন্য নেই। কিন্তু ধোনি এলেই ওই ফিল্ড। একদা টি-টোয়েন্টির সবচেয়ে বড় ঘাতক, স্পিনারদের যম, তাঁর জন্য এমন চরম অপমানজনক ফিল্ড। দ্রুত সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার ঝড় শুরু হয়ে গেল। কেউ বোকা নয়। সবাই বুঝছে।
এর চেয়ে রোমাঞ্চকর স্লেজিং আর কী হতে পারে! যে তুই এক সময়ের সম্রাট ছিলি। এখন তোর রথের চাকা মাটিতে বসে গিয়েছে। যা কর্মফল ভোগ কর!
কেন এত রাগ গম্ভীরের? ভারতীয় ড্রেসিংরুমের গসিপ বিশ্বাস করলে অধিনায়কত্ব পাওয়ার ব্যাপারে গম্ভীর একটা সময় পুণে অধিনায়কের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিলেন। শ্রীনিবাসন রুল বই ছুড়ে দিয়ে মোহিন্দর অমরনাথকে থামিয়ে না দিলে গম্ভীরের ক্যাপ্টেন হয়ে যাওয়ারই কথা। ওই সময় টিম ভাল খেলছে না জাতীয় সমালোচনামূলক কিছু মন্তব্য কেকেআর ক্যাপ্টেন নাকি একান্তে করেছিলেন। ধোনির কাছে যা আনুগত্যের চরম অভাব হিসেবে ধেয়ে আসে। আর কে না জানে ধোনি-সাম্রাজ্যে আনুগত্যের অভাব মানে দেশদ্রোহিতা। শাস্তি খুব সিম্পল। উল্টো গাধার পিঠে চাপিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটবিশ্ব থেকে নির্বাসন।
গম্ভীর গত চার বছরে দু’টো আইপিএল জিতেছেন। কিন্তু ভারতীয় ক্যাপ ফেরত পাননি। শিখর ধবন বারবার ব্যর্থ হলেও নির্বাচনী বৈঠকে অন্য কোনও নাম শুনতে রাজি হননি ধোনি। দিল্লি থেকে বাঁ হাতি আর কারও তো নয়ই। এর পর এমএসডির জন্য গরগরে প্রতিহিংসার গরল ছাড়া তাঁর গম্ভীরের আর কী-ই বা দেওয়ার থাকতে পারে?     
অবাক লাগছিল ইডেনে বসে যে দিন কোহালি আর ডে’ভিলিয়ার্স রানের ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন সে দিন কি না পুণে এমন কুঁকড়ে থেকে ব্যাটিং করছে? তাদের দলে ধোনি থেকেও? ধোনির পুণে আর সৌরভের পুরনো পুণে ফের মিশে গেল। একটা দল শেষ করেছিল তালিকার সব শেষে থেকে। আর একটা নিশ্চিত ভাবে সে দিকে এগোচ্ছে।
কী মনে হচ্ছে সৌরভের? কী মনে হতে পারে? জীবদ্দশাতেই দিয়ে যেতে হবে বন্ধু!
সংক্ষিপ্ত স্কোর: রাইজিং পুণে ১৭.৪ ওভারে ১০৩-৬ (বেইলি ৩৩, পীযূষ ২-২১), কলকাতা নাইট রাইডার্স ৫ ওভারে ৬৬-২   (ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে জয়ী)।