টিম হেরে গেলে সাধারণত তাঁকে ইডেনে নেমে বিশেষ কিছু করতে দেখা যায় না। কিন্তু সোমবার শাহরুখ খান শুধু ইডেনে নামলেনই না, ছোট্ট আব্রামের হাত ধরে রীতিমতো চক্কর দিলেন। বি ব্লক। বি থেকে ডি। ডি থেকে এল। এল ঘুরে শেষ পর্যন্ত ক্লাবহাউস লন লাগোয়া আরসিবি ডাগআউটের সামনে। আর ঠিক তখনই রাতের ইডেনের সবচেয়ে মায়াবী মুহূর্তটা তৈরি হল!
ক্লাবহাউস লনে দাঁড়িয়ে কিংগ খান। ক্লাবহাউস লনে দাঁড়িয়ে কিংগ কোহালি। পাঁচ হাত ব্যবধানে মুখোমুখি দুই রাজা।

শুষ্ক হাত মেলানো? নাহ্, হল না। যন্ত্রণাকাতর মুখে মহানায়কের পিঠ চাপড়ে দেওয়া? এটাও হয়নি। পাশ দিয়ে সোজা হেঁটে যাওয়া? ধুর, শাহরুখ খানের ডিকশনারিতে ও সব আছে নাকি?
কিংগ খান সোজা কিংগ কোহালিকে জড়িয়ে ধরলেন! জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে, যিনি তাঁর প্রাণের কেকেআরকে রক্তাক্ত করে ম্যাচ নিয়ে চলে গিয়েছেন পাঁচ মিনিট আগে!
মাঝরাতের ইডেনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, ঠিকই আছে। রাত আটটা থেকে পরবর্তী সাড়ে তিন ঘণ্টায় ইডেন যা যা দেখেছে, যা যা করেছে, তাতে দ্বিতীয় কোনও টিমের অস্তিত্ব কোথায় ছিল? মিলেনিয়াম পার্ক থেকে হাওড়া ব্রিজ— গঙ্গাবক্ষের বিভিন্ন লোকেশনে যে গর্জনটা মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ছিল পার্শ্ববর্তী স্টেডিয়াম থেকে, কী ব্যাখ্যা হয় তার? কেকেআর, কলকাতার এত দিনের হৃদয় কেকেআর, তার তো কোনও চিহ্ন থাকল না। বিরাট কোহালি নামক অনন্ত আবেগের খরস্রোতের সামনে পড়ে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল! বলিউড-রাজা আজ ক্রিকেটের রাজাকে জড়িয়ে ধরবেন না তো আর কবে ধরবেন? তিনি বাজিগর, প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়ে জেতার মাধুর্য তাঁর চেয়ে ভাল আর কে বুঝবেন?

শাসন কিংগ কোহালির। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
বিরাট কোহালির হাতে কিছু না হলে আজ রাতে অন্তত সাত-আটটা স্টিচ পড়বে!
গভীর রাতে শোনা গেল, ইডেন থেকেই শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিরাটকে। ফিল্ডিং করতে গিয়ে বাঁ হাত এতটাই কেটে যায় যে, মাঠ ছেড়েই বেরিয়ে যেতে হয় তাঁকে। কিছুক্ষণ অদৃশ্য থাকার পর আবার মাঠে আবির্ভাবে তখনকার মতো বোঝা যায়নি। পরে গেল। যখন টিভি ক্যামেরার সামনে তিনি এলেন। আর ক্রিকেট-পৃথিবী জানতে পারল ড্রেসিংরুমে ফিজিওকে দেখামাত্র বিরাট বলে দিয়েছিলেন, জানি অনেকটা কেটেছে। এটাও জানি যে, সাত-আটটা স্টিচ পড়বে। কিন্তু এখন ও সব জেনে লাভ নেই। তুমি যে ভাবে পারো আমাকে ঠিক করো। আমাকে ব্যাট করতে হবে!
আইপিএল ইতিহাসে চোট পেয়েও প্রাণান্ত চেষ্টার উদাহরণ অতীতে আছে। ছ’বছর আগে এক মরাঠির এই আরসিবি-র বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল খেলতে গিয়ে হাতে পাঁচটা স্টিচ পড়েছিল। তবু সে বার ফাইনালে নেমেছিলেন সচিন তেন্ডুলকর। কিন্তু টিমকে জেতাতে পারেননি। ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর উত্তরসূরির কাছেও এটা একপ্রকার ফাইনালই ছিল। হারলে প্লে-অফের দৌড় থেকে ছিটকে যেতে হত। এবং আবারও সেই হাতে লাগল। শুধু তিনি পারলেন। জিতে বেরোলেন।
আর যে দৃশ্য দেখলে নিজের চোখকে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করবে না, সেখানে ঘরের টিমের জয়-হারের ক্ষুদ্র বৃত্তে আটকে থাকা কী ভাবে সম্ভব? ইডেন পারেনি। জয়-পরাজয়ের ঊর্ধ্বে উঠে অনেক, অনেক আগে সে স্পষ্ট করে দিয়েছে তার সমর্থনের মেরুকরণ। কিন্তু ইডেনে উপস্থিত ক্রিকেটারকুল? তাঁরাও তো সমান বিভোর, সমান মোহাচ্ছন্ন। নামগুলো শুনবেন? সুনীল গাওস্কর। ক্রিস গেইল। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। কথাবার্তায়, মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশে সবাই কোথাও গিয়ে যেন ক্লাবহাউসের লোয়ার টিয়ারের সেই তরুণ, যে বিরাট-এবির বাউন্ডারি-ওভার বাউন্ডারিতে সসম্মান অভিবাদনে শরীর ঝুঁকিয়ে দিচ্ছিল!
সিএবি প্রেসিডেন্টকে মাঝরাতে তাঁর অফিসে বিমুগ্ধ ভাবে বলতে শোনা গেল, “ক্লাস, পুরো ক্লাস। একজন নয়, দু’জন জিনিয়াসকে আজ দেখল ইডেন। কী ব্যাটিং রে বাবা। শুরুটা কিন্তু আজ গেইল করল। প্লে অফে গেলে ওরাই টিম টু বিট হবে।” আর ইডেনের বিভাজন? বিরাট-সমর্থনে ইডেনের এতটা একপেশে হয়ে যাওয়া মনে পড়ায়নি ৫ মে? “আমি ও সব ফেলে এসেছি। কিন্তু আজ যা হল, সারপ্রাইজিং না? আলটিমেটলি, ইটস অল অ্যাবাউট প্লেয়ার।”
সুনীল গাওস্করের মতো প্রবাদপ্রতিমের কাছেও সোমবারের এবি-বিরাট শো “প্রিভিলেজ টু ওয়াচ।” ক্রিস গেইলের কাছে এঁরা দুই খুব সহজ-সরল চরিত্র। একজন ব্যাটম্যান। একজন সুপারম্যান! আর রামিজ রাজার কাছে বাইশ গজের এক অসাধারণ ‘লাভ স্টোরি’ যা বিশ্বজোড়া সমস্ত ‘কাপলের’ মধ্যে তিনি এর পর দেখতে চান! যে জুটিকে কথা বলতে হয় না, ইশারায় কাজ হয়ে যায়।
আসলে এঁরা কেউ সোমবার মাঠে ছিলেন না। এঁরা কেউ রক্তমাংসের ক্রিকেটও দেখেননি। ছেষট্টি হাজারের সঙ্গে এঁরাও সাড়ে তিন ঘণ্টার জন্য ক্রিকেট-স্বর্গে ঘুরতে গিয়েছিলেন!