রাজকুমার মন্ডল, গুয়াহাটি: গালভর্তি খোঁচা সাদা দাড়ি। চেহারায় ভাঙন ধরেছে। আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গোলপোস্ট ধরে। আনকোরা ফুটবলারদের দাপাদাপি দেখে আপন মনে হাসছেন। স্থির থাকতে না পেরে আবার দৌড়ে গিয়ে শুধরে দিচ্ছেন ভুলগুলো। গুয়াহাটি নেহরু স্টেডিয়ামে এই দৃশ্যের চরিত্র খোদ কলকাতা ময়দান কাঁপানো আটের দশকের স্ট্রাইকার দেবাশিস রায়। যাঁকে সবাই ‘দেবাদা’ বলেই চিনত।
আজ হয়ত ভুলে গেছেন অনেকেই। না হলে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে গুয়াহাটির ইন্দিরা গান্ধী স্টেডিয়ামে অন্তত কর্তব্যের খাতিরেও মোহনকর্তারা আমন্ত্রণ জানাতেন চার বছর বাগানে খেলা স্ট্রাইকারকে। ১৯৮৬–র কলকাতা লিগে সবুজ–মেরুনের হয়েই ১৯ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার তকমা পেয়েছিলেন। অথচ, আজ কেউ মনে রাখেননি মজিদ বাসকারের সঙ্গে খেলা দেবাকে। ১৯৭৬–এ ভারতীয় জুনিয়র দলে সুযোগ। পরের বছরই জাতীয় জুনিয়র দলের সহ–অধিনায়ক। সে দলের অধিনায়ক ছিলেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। ১৯৭৭–এ এফ সি আইয়ের চাকরি পান এবং গুয়াহাটির টাউন ক্লাবে খেলার সময় ডাক আসে কলকাতা ময়দানে। ১৯৭৯–তে এরিয়ানে খেলে বাংলার হয়ে সন্তোষ জয়। বড় দলে ডাক পরের মরশুমেই। জামসিদ নাসিরি, মজিদ বাসকারের সঙ্গে মহমেডান স্পোর্টিংয়ে ১৯৮২ পর্যন্ত। ওই বছরই এশিয়ান গেমসে কৃশানু, প্রসূন, সুব্রতর মতো তারকাদের মাঝেও চমক দিয়েছিলেন দেবা। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ ইস্টবেঙ্গলে থাকাকালীন ১৯৮৪–তে ২৫ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা। ১৯৮৬–৮৯ মোহনবাগানে দাপিয়ে খেলার সময় ডান পায়ের কাফ মাসলের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গুরুতর চোট। তারপর থেমে যেতে হয় বহু যুদ্ধের নায়ক, পি কে–চুনীর নয়নের মণি দেবাশিসকে। ফুটবলকে ভুলবেন কী করে বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এফ সি আই গুয়াহাটির কোচ হয়ে ফুটবলার তৈরির কাজে নেমে পড়লেন। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না জেনেও যন্ত্রণার ক্ষতে সাময়িক প্রলেপ দিতে কোচিংয়ে ব্যস্ত রাখলেন নিজেকে। অনেক লড়াই করে ফুটবলার হতে হয়েছিল, সেই লড়াই এখনও চলছে, দারিদ্রের বিরুদ্ধে। আক্ষেপের সুরে গুয়াহাটির নেহরু স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে দেবাশিস বলে চললেন, ‘ময়দান আমাকে শূন্য হাতেই ফেরত পাঠাল। ছোটবেলায় যেমন কষ্ট করে ফুটবলার হয়েছিলাম, এখনও সেই কষ্ট আমার পিছু ছাড়ল না।’ সেইসঙ্গে ঘুরেফিরে এখনও তঁার স্বপ্নে আসে কলকাতা ময়দানে খেলার সেই পুরনো ছবিগুলো।
সময়–সুযোগ হলে এখনও ফুটবল দেখেন। দেবাশিসের মতে, ব্যারেটো, ওডাফা অনেক দেখলেন। কিন্তু মজিদ বাসকারকেই তঁার চোখে দেখা সেরার আসনে বসাচ্ছেন। ভারতীয় স্ট্রাইকারকের মধ্যে পাহাড়ি ছেলে জেজে–তে মজে রয়েছেন।
অসমের করিমগঞ্জের বাড়িতে তিন দিদি, স্ত্রী-পুত্রের সংসারের দায়িত্ব সামলে বাকি সময় নিজেকে নিয়োজিত রাখলেন ফুটবলে। ২০০৯–এ চাকরি থেকেও ইতি টানলেন। বিকেল হলেই এ মাঠ–সে মাঠ করে বেড়ান ষাটোর্ধ্ব দেবা। অসমের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত ডিব্রুগড়, দিসপুর, রাবাসাম, শিবসাগর সর্বত্র অশক্ত শরীরে দৌড়ে বেড়ান ফুটবল কোচিংয়ের টানে। ‘একটু সুযোগ পেলে আমি কলকাতা ময়দানে বড় কোচেদের তালিকায় নিজের নাম বসাতে পারব, কিন্তু অর্থসম্বল নেই, লাইসেন্স পেতে কী করতে হয়, তা–ও জানা নেই। কেউ একটু সাহায্যও করে না। মোহনবাগান, ইষ্টবেঙ্গল কোনও ক্লাবই আমাকে মনে রাখেনি, যথাযথ প্রতিদান পেলাম না কলকাতা ময়দানের কাছ থেকে। খুব মিস করি ময়দানের উন্মাদনা’— মাঠের একপ্রান্তে গোলপোস্ট ধরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলতে বলতে গলা কেঁপে আসছিল বহু যুদ্ধের নায়ক দেবাশিসের।
No comments:
Post a Comment