সকালে এই লেখা হয়তো যখন আপনারা পড়ছেন তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সবাই জেনে যাবেন আগামী পাঁচ বছর এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কে?
যিনিই হবেন তাঁর কাছে আমার অনুরোধ, বাঙালির আবেগের ফুটবলকে গলা টিপে মেরে ফেলার যে গেমপ্ল্যান তৈরি করেছেন প্রফুল্ল পটেল এবং আইএমজি-আর জোট, তা ভেস্তে দিতে নামুন। গোটা বাংলা আপনার পাশে থাকবে।
খবরের কাগজে যে সব লেখা-টেখা পড়ছিলাম, মনে হচ্ছিল আইএসএল আর আই লিগ, দু’টো হয়তো শেষ পর্যন্ত এক হয়ে যাচ্ছে। বদলে মঙ্গলবার ফেডারেশনের সভায় যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে, তা অশ্বডিম্ব প্রসব ছাড়া আর কিছু না। ভারতীয় ফুটবলের একটা স্বার্থান্বেষী চক্র দু’টো লিগ এক করার বদলে কায়দা করে ফিফার অনুমোদনহীন আইএসএলকে দেশের সর্বোচ্চ লিগ করে দিতে চাইছে।
আর আমাদের গর্বের মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল-মহমেডান?
তাদের ওই লিগ খেলতে গেলে বাজেটের চেয়ে দ্বিগুণ-তিন গুণ টাকা দিয়ে অংশগ্রহণ করতে হবে। না হলে চলে যেতে হবে লিগ ওয়ানে। যেটা আদতে দেশের দ্বিতীয় ডিভিশন লিগ। ব্যাপারটা এ রকম— টাকা থাকলে তুমি কুলীনদের লিগে আছো। নইলে নেই। এর চেয়ে লজ্জার এবং পরিতাপের বিষয় বাংলার ফুটবলে আর কখনও এসেছে বলে মনে পড়ছে না। ব্যাপারটা যেন এ রকম, ব্রাজিল ফুটবলে সংস্কার দরকার। তা করতে গিয়ে ওদের ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট সাও পাওলো, স্যান্টোসের মতো দলগুলোকে ঠেলে দিল দ্বিতীয় সারির লিগে। আর কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজি টিম নিয়ে শুরু হল নতুন পেলে, নেইমার খোঁজার অভিযান। এ তো কালীপুজোর রাতে হাউই উড়িয়ে চাঁদের মুখে ছাই মাখিয়ে আসার মূর্খামি।
ফুটবলের সঙ্গে ছয় দশকেরও বেশি সময় জড়িয়ে থাকার ভিত্তিতে বলতে পারি, শুধু ফ্র্যাঞ্চাইজি ফুটবল দিয়ে কোনও দেশের ফুটবল এগিয়ে যেতে পারেনি। পারবে না। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এমনকী এশিয়ায় ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম সারিতে থাকা দেশগুলোতেও এ রকমটা হয়েছে বলে শুনিনি। দেখিনি।
এগুলো তাঁদের মাথা থেকেই বার হতে পারে যারা ফুটবল অজ্ঞ। কয়েক মাস আগে খবরের কাগজেই পড়েছি, ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনে প্রেসিডেন্ট প্রফুল্ল পটেলের পা-ই পড়ে না। সারা জীবনে তিনি এ দেশের দশটা ফুটবল ম্যাচ দেখেছেন কি না সন্দেহ! আজ সেই তিনি ভারতীয় ফুটবলে মক্কা কলকাতার ফুটবল আবেগকে দূরে সরিয়ে আইএমজি-আরের ধামা ধরে আইএসএলকে প্রধান লিগ করতে চলেছেন! জানেন কলকাতার তিন প্রধানের ইতিহাস-ঐতিহ্য? জানেন, ১৯২৮ আমস্টারডাম অলিম্পিক্সে প্রথম সোনাজয়ী ভারতীয় হকি দলের জাহাজ ভাড়ার খরচটা তাঁর ওই কুপারেজেই প্রীতি ম্যাচ খেলে তুলে দিয়েছিল মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল! আর আজ নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে সেই দুই ক্লাবকেই তিনি পাঠিয়ে দিতে চাইছেন দ্বিতীয় সারির লিগ ওয়ানে। একশো পেরনো আর একশো বছর ছুঁইছুঁই কলকাতার তিন প্রধানকে নাকি ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির রোডম্যাপ চিনতে হবে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের হাত ধরে! ভারতীয় ফুটবলের কী পরিহাস!
মাননীয় প্রফুল্ল পটেল জেনে রাখুন, ক্লাব ফুটবল ছাড়া দেশের ফুটবলের কোনও উন্নতি সম্ভব নয়। যত সব উদ্ভট থিওরি সামনে এনে আপনারা ফ্র্যাঞ্চাইজি টিমকে এএফসি টুর্নামেন্ট খেলার পাসপোর্ট জোগাড় করে দিতে পারেন, কিন্তু জাতীয় দলকে এক চুলও এগিয়ে দিতে পারবেন না। গোটা পৃথিবীর ফুটবল যে ভাবে ক্লাবকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে, তার বিপরীত স্রোতে সাঁতার কাটতে গেলে এ দেশের ফুটবলটাই ধ্বংস হবে।
মঙ্গলবারের সভায় আমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। যাইনি ব্যক্তিগত কারণে। সভায় আমার পুত্রসম ভাইচুং ভুটিয়া-সুনীল ছেত্রী ছিল। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে যাদের গোটা ভারত চিনেছে। শুনলাম সভায় ভাইচুংও নাকি চেয়েছে আইএসএল এবং আই লিগ আলাদা চলুক। আমি তো মনে করি আইএসএলের আটটা টিম আর আই লিগের আটটা টিম নিয়ে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ হলে দেশের ফুটবলই অনেক গতি পাবে।
ফুটবলের বিপণনের দিকটা প্রফুল্ল পটেলরা ভেবেছেন কি? তা হলে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলকে উপেক্ষা করছেন কী ভাবে? এই দুই ক্লাবের দেশজোড়া (এমনকী বিদেশেও) সমর্থকের ধারে-কাছে পৌঁছতে পারবে না আইএসএলের সব দলের মিলিত দর্শক সংখ্যাও। সমর্থক ছেড়ে দিন। মোহন-ইস্টের যত সদস্য, তত দর্শকও বোধহয় সল্টলেক স্টেডিয়ামে আটলেটিকো দে কলকাতার খেলায় ভিড় করে কি না সন্দেহ।
মঙ্গলবারের মিটিংয়ে নাকি প্রফুল্ল বলেছেন, যদি কলকাতার টিমগুলোর এত ঐতিহ্য থাকে তা হলে ওদের জন্য কেউ টাকার ঝুলি নিয়ে এগিয়ে আসছে না কেন? মানছি, কলকাতার তিন প্রধানের কর্তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা টিমের বাজেট পাঁচ-দশ লক্ষ টাকা থেকে আজ ১০-১৫ কোটিতে নিয়ে গিয়েছেন। এখন ওদের বাজেট রাতারাতি ৩৫-৫০ কোটি করতে বলার অর্থ আসলে ভারতীয় ফুটবল থেকে বাংলার ফুটবল আবেগকে ব্রাত্য করে দেওয়া। আরও একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। মিটিংয়ে যে প্রস্তাব উঠে এসেছে তাতে তো সাত বছর আইএসএলে অবনমন নেই। লিগ ওয়ান থেকে টিম আইএসএলে উঠবে না। যদি কোনও ক্লাসে পাস-ফেল না থাকে ছাত্ররা পড়াশোনা করবে কেন? যদিও আমি আশা রাখি হয়তো প্রফুল্ল পটেল মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলকে বাদ দিয়ে কিছু করবেন না।
আর গত আই লিগেও ক্লাবগুলোর থেকে দশ লক্ষ টাকা নেওয়া হয়েছে প্রচারের জন্য। অথচ আই লিগ নিয়ে কী প্রচার দেখেছেন? ফুটবলের পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য ক্লাবগুলোকে কী আর্থিক সাহায্য করেছে ফেডারেশন? সব দেখে ফিফার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট স্যার স্ট্যানলি রাউসের কথা মনে পড়ছে। মেলবোর্ন অলিম্পিকে তিনি ফুটবলে ভারতের চতুর্থ হওয়ার পর এশিয়ার দেশগুলোকে বলতেন, ‘‘ওয়াচ অ্যান্ড ফলো ইন্ডিয়া।’’ বেঁচে থাকলে রাউস হয়তো এখন ভারতীয় ফুটবল নিয়ে ফেডারেশনের এই তামাশা দেখে বলতেন, ‘‘ওয়াচ অ্যান্ড ডোন্ট ফলো ইন্ডিয়া।’’
No comments:
Post a Comment