সামনে খোলা ল্যাপটপ।
মিডিয়ার লোক ঘরে ঢুকলেই সেটা বন্ধ করে দিচ্ছেন।
বারবার কী দেখছেন ল্যাপটপে? প্রশ্ন করলেই হেসে এড়িয়ে যাচ্ছেন। ‘‘ওই একটু পড়াশোনা করছিলাম।’’
খোঁজ নিলে অবশ্য জানতে পারা যাবে, সনি-গ্লেনদের খুঁটিনাটি আইজল কোচের ওই ল্যাপটপে বন্দি।
সঞ্জয় সেনের এ মরসুমের প্রত্যেক ম্যাচের স্ট্র্যাটেজি। সনি-কাতসুমির উইং-দৌড়। পেনাল্টি বক্সে জেজে কী করেন। লুসিয়ানো কী ভাবে ট্যাকল করেন। সব। সব। সব।
‘‘কোচেদের হতে হয় ক্ষত্রিয় গোত্রের। মাঠে সামনে পরমাত্মীয় পড়লে তাকেও হারাতে হবে। আমিও সে রকম। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করাই আমার কাজ,’’ বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন জহর। রাজেশ খন্নার মতো ঘাড় বেঁকিয়ে প্রাক্তন মোহনবাগান ফরোয়ার্ড হেসে যোগ করেন, ‘‘প্যাশন আর প্রফেশন এক করাটা কিন্তু ঠিক নয়।’’
আইজল কোচের যে কাল ধর্মযুদ্ধ!
তিরিশ বছর যাবত সবুজ-মেরুনের সদস্যও তিনি। জহরের অধ্যাপক মেয়েও মোহনবাগান মেম্বার। বাগান সচিব তাঁর স্কুলের বন্ধু। আবার মুদ্রার উল্টো পিঠও আছে। পাঁচ ম্যাচ মোহনবাগানকে কোচিং করার পরে বিতাড়িত হতে হয়েছিল জহরকে। ‘ড্র দাস’ বদনাম মাথায় নিয়ে। কারণ? গোয়ার মাঠে আই লিগে তিনটি ম্যাচ ড্র করেছিলেন বলে। মোহনবাগানের জুনিয়র টিমকেও কোচিং করিয়েছেন।
‘নাড়ির যোগ সবুজ ঘাসে’ থাকা সত্ত্বেও অঞ্জন দত্তদের বাগানের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার রোড ম্যাপ তৈরিতে জহর এই মুহূর্তে ডুবে রয়েছেন। এতটাই যে, সকালে কলকাতা থেকে আসা মিডিয়ার লোকজনকে দেখে জীবনে প্রথম বার ‘ক্লোজড ডোর’ অনুশীলন করিয়েছেন তিনি। ‘‘এ রকম সুযোগ কি কখনও আসবে ভাই? সারা জীবন তো জুনিয়রদেরই কোচিং করিয়েছি। কুড়িটা টিমকে তৈরি করেছি। ফেড কাপের মতো টুনার্মেন্ট জেতার সুযোগ কবে আর এসেছে আমার!’’ লাল হয়ে ওঠা ফর্সা মুখ থেকে কথাগুলো বেরোনোর সময় পুরু লেন্সের চশমার আড়াল থেকে যেন আগুন ঝলসে বেরোয় জহরের। কিছু করে দেখানোর নেশায় মাতোয়ারা যেন তিনি!
নিজের পুরনো দলকে হারানোর জন্য এতটা মরিয়া? অন্যায় ভাবে মোহনবাগান আপনাকে বাতিল করেছিল বলেই কি? বাংলার প্রথম ‘এ’ লাইসেন্স নেওয়া ৬৮ বছরের ভদ্র ফুটবল কোচও জবাবে প্রায় চিৎকার করে ওঠেন, ‘‘এমন কোনও ফুটবল কোচ আছে কি, যে জীবনে বাতিল হয়নি। তো আমিও হয়েছি। ওই সবে কিছু হয় না। কাল যেন আমি অর্জুন হতে পারি। সেটা চেষ্টাই করছি। লক্ষ্যভেদ।’’
সনিদের হারিয়ে ট্রফি জিতলে তো বাগান সমর্থকেরা আপনাকে বিভীষণও বলবে? ‘‘তা বলুক। আমরা তো ইতিহাসও গড়ব। সেটা বলবে না?’’ বিপক্ষে সনি-গ্লেন-জেজে। গোল আটকাবেন কী করে? আরও যেন তেতে ওঠেন জহর। ‘‘খেলাটা শুরু হতে দিন, দেখতে পাবেন।’’ সকালের অনুশীলনে দেখা গেল আইজল কোচও তাঁর ফুটবলারদের সঙ্গে দৌড়চ্ছেন সমান তালে। দফায় দফায় টিম মিটিং চলছে হোটেলে। প্রেস কনফারেন্সে সামনে রাখা ফেড কাপটা দেখছিলেন জহর। পাশে বসে থাকা টিমের স্টপার অ্যালফ্রেডকে বললেন, ‘‘কাল ওটা হাতে নিতে হবেই।’’ অনুশীলনেও যখন পুরো টিম একসঙ্গে ছবি তুলছে তখন জহরকে বলতে শোনা গেল, ‘কাল এ রকম একটা ছবি দেখতে চাই। তবে ফেড কাপটা নিয়ে।’’
খাতায়-কলমে অসম যুদ্ধে নেমেছেন হাওড়ার মোহন-ভক্ত জহর দাস। কাল লড়াইটা জিতুন বা হারুন, এই বয়সেও তাঁর তাগিদ, ইচ্ছাশক্তি আর এক দল আনকোরা ফুটবলারকে নিয়ে সংগ্রামকে আগাম কুর্নিশ জানাতেই হচ্ছে। লিখতেই হচ্ছে— জহর দ্য গ্রেট!
No comments:
Post a Comment