আইজল থেকে গাঁটের কড়ি খরচা করে আসা জনাচারেক ছেলেমেয়ে সকালে ইন্দিরা গাঁধী স্টেডিয়ামে এসেছিলেন টিকিটের খোঁজে। ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরির পর হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন। শনিবারের ফেড কাপ ফাইনালের কোনও টিকিট কাউন্টারই খোলা হয়নি তখনও!
দেশের ক্লাব ফুটবলের সেরা নক-আউট টুর্নামেন্ট। অথচ তার ফাইনালের শহরে ম্যাচের আগের দিনও কোথাও কোনও ব্যানার নেই, নেই বিপণনের বিন্দুমাত্র চেষ্টাও। আরও বোধহয় আশ্চর্যের, সনি নর্ডিদের টিম বাসকে যখন এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছে অসম পুলিশের এক জোড়া জিপ, তখন রাস্তার ধারে এক চা-দোকানদারের প্রশ্ন, ‘‘ভোট গণনা তো কাল হয়ে গিয়েছে। আজ এরা আবার কাদের নিয়ে যাচ্ছে?’’
ফাইনালের স্টে়ডিয়ামের অবস্থা আরও খারাপ। এখনও চারদিকে জঞ্জাল পরিষ্কার চলছে। এখনও গ্যালারিতে এএফসি ম্যাচের স্টিকার সাঁটানো! আরও বড় ঘটনা ঘটল শুক্রবার সন্ধেয়। খেলার চব্বিশ ঘণ্টা আগেও ম্যাচ কমিশনারই না এসে পৌঁছনোয় নজিরবিহীন ভাবে ভেস্তে গেলে ফেড কাপ ফাইনালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ— ম্যানেজার্স মিটিং! যে মিটিংয়ে জার্সির রং থেকে ম্যাচের যাবতীয় নিয়মাবলী— সব কিছু বলে দেওয়া হয় অংশগ্রহণকারী দু’দলকে। সংগঠকদের অপদার্থতার কারণে যা উহ্যই থেকে গেল!
আইজল কোচ জহর দাস মাঠের অবস্থা নিয়ে এখনই তোপ দাগছেন— ‘‘এটা মাঠ! কাদায় ছ’ইঞ্চি পা ডুবে যাচ্ছে। গোলপোস্টের সামনে বল গড়াচ্ছেই না।’’
দেশের সেরা ফুটবল ক্লাব বাছার চূড়ান্ত লড়াই। চ্যাম্পিয়ন দল খেলবে এএফসি-তে। অথচ প্রেসি়ডেন্ট-সচিব বা অন্য কোনও ফেডারেশন কর্তা এখানে নেই। দিল্লির ফুটবল হাউসের জনা দুই অফিস কর্মী এসেছেন শুধু। অব্যবস্থার জন্য যাঁর দিকে আঙুল উঠছে এখানে, সেই অসম ফুটবল সংস্থার প্রধান কর্তা অঙ্কুর দত্ত আবার পাল্টা দোষ দিলেন ফেডারেশনকেই। ‘‘মোটে পাঁচ দিন আগেই তো আমাকে বলল জম্মু-কাশ্মীরের বদলে গুয়াহাটিতে ফাইনাল হবে। আমি বলেই দায়িত্ব নিয়েছি। এত কম সময়ের মধ্যে সব করা যায় না কি?’’
কেন দায়িত্ব নিয়েছেন তার একটা আন্দাজ পাওয়া গেল অবশ্য কিছুক্ষণ পরেই। যখন জানা গেল, শুধু ফাইনালের প্রচারের জন্যই চার লাখ দিয়েছে ফেডারেশন অসম ফুটবলকে। সেই টাকা কোথায় গেল? ফেডারেশনের কর্মসমিতির সদস্য অঙ্কুরের জবাব, ‘‘লোকাল চ্যানেলে বিজ্ঞাপন চলছে। আর টিকিট বিক্রি হচ্ছে রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে।’’
লোকে রাস্তায় গাড়ির খোঁজ করবে টিকিটের জন্য? এ বার অঙ্কুরের নির্লিপ্ত জবাব, ‘‘বিকেলে কাউন্টার খুলবে। ম্যাচের আগে সবাই টিকিট পাবে।’’ অথচ শুধু বিপণনের কল্যাণে এই স্টেডিয়ামেই মাস কয়েক আগে আইএসএলে নর্থ ইস্টের খেলা দেখতে উপচে পড়েছে ভিড়! নীতা অম্বানীদের ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের অন্ধভক্ত ফেডারেশন যদি ওই মশালা টুর্নামেন্টের ভাল দিকগুলোও যদি নিতে পারত!
প্রফুল্ল পটেল অ্যান্ড কোম্পানির অপদার্থ হাতে পড়ে আই লিগের মতো ফেড কাপেরও যে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটছে সেটা পরিষ্কার। ‘নিউট্রাল ভেনু’র নামে কোনও রকমে ফাইনাল করাই উদ্দেশ্য কর্তাদের। এবং সেটাই হচ্ছে। অথচ উনিশ বছর আগে ফে়ড কাপ সেমিফাইনালেই পিকে-অমল দত্তের মগজাস্ত্রের লড়াই দেখতে যুবভারতীতে ছিল রেকর্ড সংখ্যক এক লাখ একত্রিশ হাজার দর্শক। যা ভারতীয় খেলাধুলার ইতিহাসে কোনও ইভেন্টে কখনও হয়নি। এমনকী এশিয়াতে সেটাই ফুটবল মাঠে সর্বোচ্চ দর্শক সমাগম। আট বছর আগেও মোহনবাগানের শেষ বার ফেড কাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দিন সল্টলেকে ছিল আশি হাজার দর্শক। এ দিন এখানে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, কাল হাজারখানেক দর্শকও যদি মাঠে থাকেন সেটাই ‘রেকর্ড’ হবে।
আইএসএলের হাতে ফেডারেশন কর্তাদের ‘বিক্রি’ হয়ে যাওয়ার মতোই ফেড কাপ ফাইনালের আগে চূড়ান্ত অব্যবস্থা দেখে হতাশ হয়ে পড়ছেন ক্লাব কর্তারা। ক্লাবদের নির্বিষ করে প্রফুল্ল পটেল-কুশল দাশরা ফ্রাঞ্চাইজিদের নিয়ে লাফালাফি করায় ক্ষুব্ধ সবাই। তার প্রভাব পড়তেও শুরু করেছে দিয়েছে। এখানে আসা বাগান-সহ সচিব সৃঞ্জয় বসু যেমন বলে দিলেন, ‘‘পরের বার আমরা কলকাতা লিগ খেলব না। কেন তিন কোটি টাকা খরচ করব ছ’টা ম্যাচ খেলার জন্য। আইএসএল বা আই লিগ যেটাই খেলি জানুয়ারি থেকে প্র্যাকটিস করলেই চলবে। ফুটবলারদের সঙ্গে সেই ভাবে চুক্তি করব। আরে, শনিবার ফেড কাপ ফাইনাল। বাংলার টিম খেলছে, অথচ আইএফএ সচিব জানেনই না। মিটিং ডেকে দিলেন। আমরা মিটিং পিছিয়ে দিতে বলেছি।’’
ফেডারেশন বনাম ক্লাব, ফেড কাপ ফাইনালের চেয়েও বোধহয় এখন বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক!
No comments:
Post a Comment