টাম্পাইন্স রোভার্স-২(জর্ডন, আফিক): মোহনবাগান-১ (বিক্রমজিৎ)
খাঁ খাঁ করছে স্টেডিয়াম।
কিছুক্ষণ আগেই নতুন অসম সরকারের শপথ গ্রহণ করিয়ে দিল্লি উড়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
স্টেডিয়ামে ঢুকতে গেলে পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে সবাইকেই। সর্বোচ্চ নিরাপত্তার কারণে যা হয়!
কোনও টিকিট কাউন্টার ছিল না। কারণ ম্যাচ আয়োজনের অনুমতি দিলেও দর্শক প্রবেশের অনুমতি দেয়নি পুলিশ। তবু জেজে-সুভাষ সিংহদের বন্ধুবান্ধব মিলিয়ে আড়াইশো মতো লোক এসেছিলেন খেলা দেখতে।
ভারতসেরা হওয়ার তিন দিনের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। খেলা একশো কুড়ি মিনিট গড়াল। একের পর এক মোহনবাগান ফুটবলার মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন ক্লান্তি, অবসন্নতায়। হাল্কা চোট পেলেও বসে যাচ্ছেন। লক্ষ্য থেকে জেদ আসে। সেই জেদই বাড়তি প্রাণশক্তি দেয়। সেটাই যেন ছিল না এ দিন। তিন দিন আগের আইজল এফসিকে হারানোর মানসিকতাটাও থাকলে এএফসি কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যেতে পারত সঞ্জয় সেনের বাগান।
সবার জানা ছিল এই ম্যাচ জিতলে সেপ্টেম্বরে পরের ম্যাচ পড়বে। তখন হয়তো বাগানেরই বিপদে পড়ার সম্ভাবনা! সনি-জেজেরা সব চলে যাবেন আইএসএল খেলতে। যাঁরা পড়ে থাকবেন তাঁদের নিয়ে এএফসি টুর্নামেন্টের নকআউট পর্যায়ে নামা মানে জেনে-শুনে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া! আর তখন না খেললে প্রবল আর্থিক সমস্যায় থাকা বাগানের ঘাড়ে বিশাল জরিমানা চাপবে। তাই আজকের ম্যাচে হেরে গেলেও দুঃখ নেই। কেউ অভিযোগের আঙুল তুলবে না। সমালোচনার ঢেউ উঠবে না।
তাই জেজেরা যখন একশো কুড়ি মিনিট ‘লড়াই’-এর পর হেরে টিমবাসে উঠছেন, কয়েকজন কট্টর সবুজ-মেরুন সমর্থক হাততালি দিচ্ছিলেন। যদিও হতাশ চোখ নিয়ে সে দিকে তাকিয়েছিলেন সঞ্জয় সেন। বাগানের বাঙালি কোচের আন্তর্জাতিক সাফল্যের উত্তরণের স্বপ্নভঙ্গের কারণেই নিশ্চয়ই। অসহায় ভাবে তাঁকে বলতে শোনা গেল, ‘‘জিতলেও তো কিছু হত না। সেই সেপ্টেম্বরে কে খেলবে পরের ম্যাচ! সবাই তো তখন আইএসএলে।’’ সঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি— ‘‘ইস্টবেঙ্গল, ডেম্পো যখন এএফসি কাপে সেমিফাইনাল খেলেছিল তখন কিন্তু আইএসএল ছিল না।’’ কোচ যখন এ সব বলছেন তখন ব্যাগপত্তর গুছিয়ে ফেলেছেন প্রায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচা ক্লাব কর্মীরা। তাঁরাও বেঁচে গেলেন আর আন্তর্জাতিক ম্যাচের আয়োজন করতে হবে না ভেবে!
অনেক মোহন-কর্তাই চাইছিলেন না ম্যাচটা জিতুক টিম। ফেডারেশনের ফুটবল ক্যালেন্ডার এমন ভাবে তৈরি যেখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচের চেয়ে মশালা টুর্নামেন্ট আইএসএলের গুরুত্ব বেশি। বিশ্বের কোনও দেশে যা হয় না প্রফুল্ল পটেল অ্যান্ড কোম্পানি তাই করে রেখেছে। সে জন্যই এএফসি কাপে দেশের কোনও টিম কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে পারে জেনেও ঠিক সেই সময় নীতা অম্বানীর ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট ফেলে দিয়েছেন। এঁরাই না কি এ দেশের ফুটবলের উন্নতি করবেন!
আর্মান্দো কোলাসো, মার্কোস ফালোপা, সুভাষ ভৌমিকের মতো কোচেরা কেউ কেউ মাঝেমধ্যে স্বপ্ন দেখেছেন, ভারতীয় ফুটবলের ডোবা থেকে বেরিয়ে এএফসি-র নদীতে সাঁতরানোর। বাগান কোচ সঞ্জয়ও এ বার দায়িত্ব নেওয়ার পর ছিলেন সেই স্বপ্নের সওদাগর। আই লিগ হাতছাড়া হওয়ার পর তিনি ড্রেসিংরুমে জেজে-কিংশুকদের যে দুটো স্বপ্ন দেখতে বলেছিলেন, তার একটা ফেড কাপ, অন্যটা এএফসি কাপ। একটা হল, অন্যটা হল না। অতিরিক্ত সময়ের একশো সতেরো মিনিটে গোল খেয়ে হেরে যাওয়ার পর দেশের সেরা ক্লাব কোচ সঞ্জয় সেনের গলায় হতাশা। ‘‘পরিস্থিতি অনুযায়ী যতটা ক্ষমতা ছিল চেষ্টা করেছে ছেলেরা। এত কম সময়ের মধ্যে এ রকম গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা কঠিন।’’ পরের বার কোচিং করাবেন বাগানেই। পরিস্থিতিও জানেন। এর বেশি আর তাই কী-ই বা বলবেন।
অথচ এই ম্যাচটা জিততেই পারত বাগান। সনি-কাতসুমি না থাকুন, বিপক্ষ তো হাফটাইমের পরেই দশ জন হয়ে গিয়েছিল লাল কার্ডে। অতিরিক্ত সময় মিলে সাতষট্টি মিনিট একজন কম নিয়েও সিঙ্গাপুরের টিমটা জিতল শুধু লক্ষ্য ঠিক রেখে। জিতব এই জেদ শেষ পর্যন্ত বজায় রেখে।
তীব্র গরম আর আর্দ্রতায় মাঠে বসে থাকাই কষ্টকর ছিল আজ। এই অবস্থায় ম্যাচটা দারুণ কোনও উচ্চতায় পৌঁছবে কেউই আশা করেনি। হয়ওনি। তারই মধ্যে নির্ধারিত সময়ের দু’টো গোল চমকে দিল। টাম্পাইন্সের জর্ডনের গোলটার জন্য বাগান কিপারের ভুল সিদ্ধান্ত দায়ী। অত দূর থেকে বল ভেসে আসছে গোলের দিকে, বুঝতেই পারলেন না। গোঁত্তা খেয়ে বলটা ঢুকে গেল জালে। তবে ০-১ পিছিয়ে থাকার ন’মিনিটের মধ্যে বিক্রমজিতের ১-১ করার গোলটা অসাধারণ। তিরিশ গজ দূর থেকে গোলার মতো শটটা যখন সিঙ্গাপুরের গোলে ঢুকল, তাদের কিপার স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে।
দেশের তিন ক্লাব মোট চার বার এএফসি কাপে শেষ আটে উঠেছে। তার মধ্যে বাগানের পড়শি ক্লাব দু’বার। অনেক গৌরবের সাক্ষী হলেও পালতোলা নৌকা কখনও এশীয় ফুটবলের সমুদ্রে পৌঁছয়নি। কিন্তু ম্যাচটা খেলার আগেই এমন সব ঘটনা ঘটে গেল, সঞ্জয়কে হাল ছাড়াই নৌকো চালাতে হল। সনি, কাতসুমি, প্রীতম, প্রণয়— ফেড কাপ জয়ী টিমের চার স্তম্ভ-ই খেলতে পারেননি নানা কারণে। দুই বিদেশি নিয়ে খেলতে নেমে আটত্রিশ মিনিটে এক জনকে হারাতে হল বাগানকে। কর্নেল গ্লেন চোট পেয়ে বসে গেলেন। সিঙ্গাপুরের টিমটা আহামরি নয়। উল্টে বিরতির পর ঝামেলা করে মার্চিং অর্ডার পান টাম্পাইন্সের সাকির। এমন সুযোগও নিতে পারলেন না লুসিয়ানোরা।
ম্যাচ শেষে কোচ সুন্দরমূর্তিকে মাঠেই ফেয়ারওয়েল দিলেন টাম্পাইন্স ফুটবলাররা। এর পরেই তো তিনি চলে যাচ্ছেন সিঙ্গাপুর জাতীয় দলের কোচিংয়ে। আর সেটা দেখতে দেখতেই মাঠ ছাড়লেন বাগান কোচ। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে।
মোহনবাগান: অর্ণব, রাজু, লুসিয়ানো, কিংশুক, ধনচন্দ্র, কেন লুইস, লেনি (শৌভিক), বিক্রমজিৎ, তীর্থঙ্কর (অভিষেক), গ্লেন (সুভাষ), জেজে।
No comments:
Post a Comment