পাঁচ গোলের পর যখন টিভির সামনে থেকে উঠলাম, একটা কথাই কানে বাজছিল। আত্মবিশ্বাসের ওভারডোজই আমাদের সেই সাত্তাতরের টিমের থেকে সঞ্জয় সেনের এই টিমকে আলাদা করে দিল।
তখন ম্যাচের আগের দিন সিনেমা দেখতে ছুটত হাবিবদা। মনে আছে, লিগের একটা ম্যাচ। আগের দিন সিনেমা দেখাটেখে পর দিন ড্রেসিংরুমে ঢুকেছে মাত্র। গৌতম প্রশ্নবাণ ছুড়ে মারল— কেয়া হাবিবদা, হিরোইন কো দেখকর ভাবিজি ইয়াদ আয়ি না! হাবিবদা প্রথমে গৌতমের দিকে তেড়ে গেলেও পরক্ষণে দু’জনেই হাসতে-হাসতে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
সুভাষ ভৌমিক তখন আমাকে ডেকে বলল, গেল রে ম্যাচটা। দু’জনে যা হাসছে! সুভাষের আশঙ্কা যাতে সত্যি না হয়ে যায়, সেই ভেবে ছুটলাম গৌতমের কাছে। দু’জনের আড্ডার মাঝে ঢুকে বললাম, আমার অফিসের সন্টুদা (কাল্পনিক চরিত্র) বলছিল, নাটার বাচ্চা কেমন খেলে দেখব আজ? তিন গোলে জিতেছিলাম ম্যাচটা। আর ভাবতে পারবেন না, দু’টো গোল গৌতম করিয়েছিল, অন্যটা নিজে করেছিল। এবং প্রত্যেকটা গোলের পর গ্যালারির দিকে ছুটেছিল সেই সন্টুর খোঁজে!
আমাদের দুর্ভাগ্য, সাতাত্তরে প্রথম ফেড কাপ ফাইনালে টিমের ভিতরে আত্মবিশ্বাসের এমন ওভারডোজ ভরে উঠেছিল, হাসি-ঠাট্টার মধ্যে টিমকে তাতানোর কথাটাই কারও মনে পড়েনি। আরে সুভাষ আছে তো! না হলে শ্যাম। প্লাস হাবিব-আকবর। তাতেও না হলে সুব্রত ভট্টাচার্য-ই না হয় উঠে গিয়ে কর্নার থেকে হেডে গোল এনে দেবে!
সেই ফাইনালে গোল হয়নি। উল্টে আমার আর দিলীপ পালিতের ফাঁক দিয়ে আইটিআই গোল করে গিয়েছিল। তার পরেও ভাবিনি হারব। কিন্তু গোলের এত সুযোগ নষ্ট করেছিলাম, স্বয়ং প্রদীপদা ম্যাচের পরে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। মনে আছে, ওই দিন শ্যামের জন্য গ্যালারি থেকে স্লোগান উঠেছিল— ব্যাকভলিতে গোল চাই। আর শ্যাম সব বলেই ব্যাকভলি মারে প্রায়! যে বল বুকে রিসিভ করার, সেটাতেও। যেটায় হেড দিতে হবে, সেটাতেও।
সেই তুলনায় শনিবার মোহনবাগান অনেক বেশি সতর্ক ছিল। আইজল বলে একবিন্দু হাল্কা নেয়নি। সঞ্জয়ের মাথায় হয়তো প্রথম থেকেই দু’টো ব্যাপার ঘুরছিল। আই লিগ ওর চোখের সামনে দিয়ে বেঙ্গালুরু নিয়ে চলে গিয়েছে। আর সেই বেঙ্গালুরুকে ফে়ড কাপে যারা দু’বার হারিয়েছে, তাদের এক ইঞ্চি জমি ছাড়া চলবে না। ফেড কাপটা শুধু একটা ট্রফি ছিল না এ বার, গোটা মোহনবাগানের কাছে আত্মসম্মানের লড়াই হয়ে উঠেছিল। ঊনচল্লিশ বছর আগে আমাদের ঝুলিতে ট্রফি ছিল। সেখানে এ মরসুমে ট্রফিহীন না থাকার কলঙ্ক মোছার জন্য সঞ্জয়ের একমাত্র সম্বল ছিল ফেড কাপ।
তা বলে সঞ্জয়ের কৃতিত্বকে কোনও ভাবেই ছোট করছি না। পরপর দু’বছরে দু’টো জাতীয় ট্রফি জেতা তো আর মুখের কথা নয়। মোহনবাগানের কোচ হিসেবে সঞ্জয়ের যা রেকর্ড তাতে আমি এখনই কারও সঙ্গে ওর তুলনা করতে চাই না। তবে এই ধারাবাহিকতা যদি ও সামনের দু-এক বছর ধরে রাখতে পারে, তা হলে আমার বিশ্বাস প্রদীপদা আর অমলদার পরেই রাখতে পারব ওকে। হ্যাঁ, সুব্রতর নাম মাথায় রেখেই কথাটা বলছি।
No comments:
Post a Comment